নারায়ণগঞ্জের পানাম নগর ভ্রমণ – ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা
নারায়ণগঞ্জের পানাম নগর ভ্রমণ – ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা
পানাম নগর, যা বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক ও রহস্যময় স্থান হিসেবে পরিচিত, নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত। পানাম নগর এক সময় বাংলার প্রাচীন বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এবং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের এক সমৃদ্ধ নিদর্শন। এই নগরী একসময় হিন্দু ব্যবসায়ীদের প্রধান আবাসস্থল ছিল এবং এখানে নির্মিত ভবনগুলো আজও দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
পানাম নগরের ইতিহাস
পানাম নগর প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো। এটি মূলত সুলতানি ও মুঘল আমলে গড়ে ওঠে। ১৫শ থেকে ১৯শ শতকের মধ্যে পানাম নগর ছিল ব্যবসায়ীদের একটি ব্যস্ততম কেন্দ্র। এখানে কাপড়, বিশেষ করে মসলিনের ব্যবসা হতো। ব্রিটিশ শাসনামলে এটি আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে নগরী জনশূন্য হতে থাকে এবং এখন এটি কেবলমাত্র পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।
পানাম নগরের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এটি ২০০৬ সালে ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ডের (WMF) বিপদাপন্ন ১০০টি ঐতিহাসিক স্থানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই ঐতিহাসিক স্থানটি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
পানাম নগরের স্থাপত্য
নগরীতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে সারি সারি পুরনো ভবন, যেগুলোর স্থাপত্যশৈলী মুগ্ধকর। এ নগরীর বাড়িগুলোতে ইউরোপীয়, মুঘল ও বাংলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের সংমিশ্রণ দেখা যায়। প্রতিটি ভবনের দরজা-জানালা, নকশা করা বারান্দা ও অলঙ্কৃত ছাদ ঐ সময়ের উন্নত কারিগরির সাক্ষ্য বহন করে।
এই নগরীতে তিন ধরনের ভবন দেখা যায়—বাসগৃহ, ব্যবসায়িক ভবন ও প্রশাসনিক ভবন। প্রতিটি ভবনে রয়েছে লতাপাতা খচিত অলঙ্করণ, বাঁধানো বারান্দা এবং নান্দনিকভাবে ডিজাইন করা জানালা ও দরজা।
পানাম নগরের রহস্য
অনেকের মতে, পানাম নগর একটি 'ভূতুড়ে শহর'। সন্ধ্যার পর এখানে কেউ থাকে না। স্থানীয়রা বলে, রাতে এখানে কিছু রহস্যজনক আওয়াজ শোনা যায়, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। তবুও, পানাম নগরের নির্জনতা ও পরিত্যক্ত বাড়িগুলো এক ধরনের রহস্যময় আবহ সৃষ্টি করে।
দর্শনীয় স্থানসমূহ
১. পানাম নগরের প্রবেশদ্বার – পানাম নগরের প্রবেশপথটি অনেক পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী।
2. ঐতিহাসিক ভবনসমূহ – ৫২টি প্রাচীন ভবন, যা এখনো দাঁড়িয়ে আছে এবং অতীতের কাহিনি বলে।
3. সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর – পানাম নগরের খুব কাছেই অবস্থিত, যেখানে বাংলার লোকশিল্পের সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে।
4. গোয়ালদি মসজিদ – ১৫শ শতকের এই মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।
5. ইশা খাঁর দুর্গ – সোনারগাঁওয়ের আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেখানে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের ইতিহাস ফুটে ওঠে।
পানাম নগর কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে পানাম নগর যাওয়া খুব সহজ। গুলিস্তান থেকে সোনারগাঁও যাওয়ার জন্য বাস পাওয়া যায় (গ্রীন লাইন, ডিলাক্স, আনন্দ ইত্যাদি)। সোনারগাঁও পৌঁছে রিকশা বা সিএনজি নিয়ে সহজেই পানাম নগরে যাওয়া যায়।
বিশেষত, সপ্তাহান্তে ভ্রমণের জন্য এটি একটি ভালো গন্তব্য, তবে ছুটির দিনে ভিড় বেশি হতে পারে।
টিকেট মূল্য ও সময়সূচি
প্রবেশ মূল্য:
স্থানীয়দের জন্য: ২০ টাকা
বিদেশিদের জন্য: ১০০ টাকা
সময়: সকাল ৯:০০ - বিকেল ৫:০০ (সোমবার বন্ধ)
খরচ কত হতে পারে?
বাস ভাড়া: ৬০-১০০ টাকা (ঢাকা-সোনারগাঁও)
রিকশা/সিএনজি: ৫০-১০০ টাকা (সোনারগাঁও থেকে পানাম নগর)
খাবার খরচ: ২০০-৫০০ টাকা
গাইড ভাড়া (ঐচ্ছিক): ৩০০-৫০০ টাকা
মোট আনুমানিক খরচ: ৫০০-১৫০০ টাকা
পানাম নগর শুধুমাত্র একটি পর্যটন স্থান নয়, এটি আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যারা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও পুরনো স্থাপত্য দেখতে ভালোবাসেন, তাদের অবশ্যই একবার পানাম নগর ভ্রমণ করা উচিত। ইতিহাস ও রহস্যের মিশেলে গঠিত এই স্থান ভ্রমণকারীদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা হতে পারে।
প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url