বাংলাদেশে সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণের সেরা গাইড: কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, ইনানি সৈকত এবং আরো অনেক কিছু
বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত
বাংলাদেশ, যা তার সবুজ প্রকৃতি, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্য পরিচিত, সেখানে আরও একটি চমৎকার দিক রয়েছে - এর অপরূপ সমুদ্রসৈকত। বিশ্বের দীর্ঘতম অক্ষুন্ন বালির সৈকত কক্সবাজার থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিনের শান্ত জল পর্যন্ত, বাংলাদেশে রয়েছে নানা ধরনের সৈকত। আপনি যদি একটি শান্তিপূর্ণ অবকাশ বা অ্যাডভেঞ্চার প্রেমী হন, তবে বাংলাদেশে আপনার জন্য সমুদ্রসৈকতে সবই রয়েছে। এই গাইডে আমরা বাংলাদেশের সেরা সৈকত, সেখানে যাওয়ার উপায় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ সম্পর্কে আলোচনা করব।
কক্সবাজার
কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সৈকত, এবং এটি বিশ্বের দীর্ঘতম অক্ষুন্ন সমুদ্রসৈকত হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিষ্কার জল, এবং সোনালী বালি সবার মনকে মুগ্ধ করে। কক্সবাজারে অনেক ধরণের অ্যাডভেঞ্চার যেমন সার্ফিং, বীচ ভলিবল এবং সি কায়কিং করার সুযোগ আছে।কক্সবাজারে কি দেখবেন এবং করবেন
কক্সবাজারের শুধু সৈকতই নয়, আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। হিমছড়ি ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন, অথবা লাবণী বিচ এবং হিমছড়ি বিচে একটু সময় কাটাতে পারেন। এছাড়াও, মেরিন ড্রাইভ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সড়ক যা সমুদ্রের পাশ দিয়ে চলে, এখানে দাঁড়িয়ে আপনি উপভোগ করতে পারেন অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য।
কক্সবাজারের খাবার
কক্সবাজারের প্রধান আকর্ষণ হলো এখানকার সি ফুড। সেখানকার তাজা মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া এবং লবস্টার আপনাকে মুগ্ধ করবে। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে গ্রিলড ফিশ, ভুনা মাছ, চিংড়ি কড়ি, এবং বাংলা মিষ্টি যেমন রসগোল্লা ও চমচম।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাওয়ার উপায়
বাসে:
ঢাকার বিভিন্ন বাস কাউন্টার থেকে সরাসরি কক্সবাজারগামী এসি/নন-এসি বাস পাওয়া যায়।
কিছু জনপ্রিয় বাস সার্ভিস:
শ্যামলী পরিবহন
হানিফ পরিবহন
গ্রিন লাইন
এস. আলম
সময়: ১০-১২ ঘণ্টা।
ভাড়া: নন-এসি বাসের জন্য ১২০০-১৫০০ টাকা, এসি বাসের জন্য ২০০০-২৫০০ টাকা।
বিমানে:
ঢাকা থেকে কক্সবাজারের জন্য সরাসরি ফ্লাইট আছে।
এয়ারলাইন্স:
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
নভোএয়ার
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স
সময়: ১ ঘণ্টা।
ভাড়া: ৪০০০-৭০০০ টাকার মধ্যে (আগে বুকিং করলে কম ভাড়া হতে পারে)।
কক্সবাজারে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের হোটেল এবং রিসোর্ট পাওয়া যায়। লাক্সারি রিসোর্ট যেমন লং বিচ হোটেল এবং কক্সবাজার রিসোর্ট থেকে শুরু করে, বাজেট ফ্রেন্ডলি হোটেল যেমন হোটেল রয়্যাল এবং মেরমেইড বিচ রিসোর্টও রয়েছে। এছাড়াও, সৈকতের কাছে কটেজ এবং হোমস্টে গুলি যারা আরও সোজা এবং সাধারণ অভিজ্ঞতা চান, তাদের জন্য উপযুক্ত।
- অফ-পিক সিজন (এপ্রিল থেকে আগস্ট): মোটামুটি মানের নন-এসি রুম ৫০০-৭০০ টাকায় এবং এসি রুম ৮০০-১০০০ টাকায় পাওয়া যেতে পারে। বীচ থেকে দূরে অবস্থিত হোটেলগুলোর ভাড়া আরও কম হতে পারে।
- পিক সিজন (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি): যে রুম অফ-পিক সিজনে ২০০০ টাকায় পাওয়া যায়, পিক সিজনে সেটি ৫০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপ
সেন্ট মার্টিন একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ, যা বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। এখানে রয়েছে স্বচ্ছ জল, বালুকাময় সৈকত এবং নানা ধরনের সামুদ্রিক জীবন। সেন্ট মার্টিনের সৈকত বাংলাদেশের অন্য সৈকতগুলোর তুলনায় অনেকটা কম বাণিজ্যিকীকৃত, তাই যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাদের জন্য এটি আদর্শ স্থান।সেন্ট মার্টিনের দ্বীপ ভ্রমণ গাইড
সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার উপায়
সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার জন্য প্রথমে আপনাকে টেকনাফ পৌঁছাতে হবে, যা কক্সবাজার থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। টেকনাফ থেকে আপনি ফেরি ধরে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছাতে পারবেন। ফেরির যাত্রা প্রায় ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় নেয়।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিশেষত্ব
সেন্ট মার্টিনের সৈকত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রবাল প্রবাল দ্বীপের জন্য পরিচিত। এখানে আপনি স্নরকেলিং, ডাইভিং এবং প্রবাল প্রবাল প্রাচীরগুলি দেখতে পারবেন।
সেন্ট মার্টিনে সেরা সময়
সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সেরা সময় হলো শীতকাল (নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি)। এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম এবং সাগরের পরিবেশ শান্ত থাকে। বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) সাগরের অবস্থা খারাপ হওয়ায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
ঢাকা থেকে টেকনাফ
বাস:
কক্সবাজার পর্যন্ত ভাড়া উপরে উল্লেখিত, এরপর কক্সবাজার থেকে টেকনাফ:
লোকাল বাস: ১২০-২০০ টাকা।
মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কার: ১৫০০-৩০০০ টাকা (শেয়ার করলে কমে)।
কেয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজ:
ইকোনমি: ৯০০-১০০০ টাকা।
ডিলাক্স: ১৫০০ টাকা।
ভিআইপি কেবিন: ২০০০-২৫০০ টাকা।
সেন্ট মার্টিনে থাকার খরচ:
হোটেল ভাড়া:
সাধারণ হোটেল: ৫০০-১৫০০ টাকা প্রতি রাত।
রিসোর্ট: ২০০০-৫০০০ টাকা
ইনানি সৈকত
- কোথা থেকে ধরবেন: কক্সবাজার শহরের কলাতলী থেকে অটোরিকশা বা সিএনজি রিজার্ভ করতে পারবেন।
- সময়: যেতে প্রায় ৪০-৫০ মিনিট সময় লাগবে।
- ভাড়া: রিজার্ভ নিলে ৮০০-১২০০ টাকার মধ্যে পড়বে (দরদাম করবেন)। দলবদ্ধভাবে গেলে খরচ কমে যাবে।
- কোথা থেকে ধরবেন: কক্সবাজারের কলাতলী মোড় বা সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে লোকাল সিএনজি পেয়ে যাবেন।
- ভাড়া: জনপ্রতি ১০০-২০০ টাকা (শেয়ারিং)।
- সময়: ১ ঘন্টা লাগতে পারে।
- দলবদ্ধ ভ্রমণের জন্য: ইনানি সৈকতে ভ্রমণের জন্য মাইক্রোবাস বা জিপ রিজার্ভ করতে পারেন।
- ভাড়া: ১৫০০-২৫০০ টাকার মতো পড়বে।
- যদি বাইক রাইড করতে পছন্দ করেন, স্থানীয় পর্যটক গাইডরা বাইক রাইডের সুযোগ দিয়ে থাকে।
- ভাড়া: একদিকে ৩০০-৫০০ টাকা।
- লোকাল বাস: কক্সবাজার থেকে ইনানি যাওয়ার জন্য কিছু লোকাল বাস রয়েছে, তবে সেগুলো ধীরগতির।
- ভাড়া: জনপ্রতি ৮০-১৫০ টাকা।
পতেঙ্গা সৈকত
পতেঙ্গা সৈকত চট্টগ্রামের অন্যতম জনপ্রিয় সৈকত। এখানে আপনি সমুদ্রের পাশে হাঁটতে পারেন, নৌকা ভ্রমণ করতে পারেন, এবং সৈকতের পাশেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থান ঘুরে দেখতে পারেন।পতেঙ্গা সৈকতের বিশেষত্ব
পতেঙ্গা সৈকত এমন একটি স্থান যেখানে আপনি নৌকা ভ্রমণ, পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটা এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারবেন। এটি চট্টগ্রামের অন্যতম জনপ্রিয় সৈকত।
পতেঙ্গা সৈকতের আশেপাশে আকর্ষণ
চট্টগ্রামে বেড়ানোর জন্য ফয়’স লেক এবং বেটুল আমান জামে মসজিদের মতো আরও অনেক সুন্দর জায়গা রয়েছে।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়া:
বাস:
- শ্যামলী, হানিফ, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন ইত্যাদি কোম্পানির (এসি বাস: ১৪০০-২০০০ টাকা) ও (নন-এসি বাস: ৮০০-১২০০ টাকা) চট্টগ্রামে চলে।
সময় লাগে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বিভিন্ন ট্রেন রয়েছে (সুবর্ণ এক্সপ্রেস, সোনার বাংলা,)।
সময় লাগে প্রায় ৬-৭ ঘণ্টা। (শুভ্র-শোভন: ৩৫০-৪৫০ টাকা ও এসি চেয়ার: ৮০০-১২০০ টাকা)
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফ্লাইটে যেতে সময় লাগে মাত্র ১ ঘণ্টা।(একমুখী টিকিট: ৩৫০০-৭০০০ টাকা)
চট্টগ্রাম থেকে পতেঙ্গা সৈকত:
চট্টগ্রাম শহর থেকে সিএনজি (লোকাল সিএনজি: ২০০-৩০০ টাকা) বা ট্যাক্সি (রেন্ট-এ-কার বা ট্যাক্সি: ৫০০-১০০০ টাকা (আলোচনা সাপেক্ষে)।
ব্যবহার করে খুব সহজেই পতেঙ্গা সৈকতে পৌঁছানো যায়।
দূরত্ব: প্রায় ১৫ কিলোমিটার।
সময় লাগে: প্রায় ৩০-৪০ মিনিট।
সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণের পরামর্শ
১. সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন: সৈকতে দীর্ঘ সময় কাটালে ত্বকে সানবার্ন হতে পারে, তাই সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
২. যথেষ্ট পানি পান করুন: গরম পরিবেশে পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি।
৩. স্থানীয় সংস্কৃতি সম্মান করুন: সৈকতে স্থানীয় মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন এবং তাদের রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন।
৪.পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন এবং কোনো আবর্জনা না ফেলুন।
৩. স্থানীয় সংস্কৃতি সম্মান করুন: সৈকতে স্থানীয় মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন এবং তাদের রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন।
৪.পরিবেশ পরিষ্কার রাখুন এবং কোনো আবর্জনা না ফেলুন।
টিপস:
যাত্রার আগে একটি নির্দিষ্ট বাজেট ঠিক করুন।
কম্প্যাক্ট ব্যাগ প্যাক করুন। বেশি ভারী ব্যাগ আনAvoidন।
দরকারি জিনিসপত্র: সানস্ক্রিন, সানগ্লাস, ওষুধ, ছাতা।
কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, ইনানি সৈকত বা পতেঙ্গা যাওয়ার আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখুন।
সমুদ্রের জোয়ার বা ভাটা সম্পর্কে জেনে রাখুন।
সৈকতে ভ্রমণের সময় জুতা বা স্যান্ডেল পরিধান করুন, কারণ প্রবাল পাথরে পা কাটার আশঙ্কা থাকে।
জাহাজ বা বোটে যাত্রার সময় লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করুন।
স্থানীয় খাবার ট্রাই করুন, তবে খাবারের দাম আগে নিশ্চিত করুন।
সৈকতের কাছে খাবার একটু বেশি দামি হয়, সেক্ষেত্রে কাছের লোকাল দোকান বেছে নিন।
মোবাইল বা ক্যামেরা আনুন, কিন্তু সৈকতের পানির কাছাকাছি ব্যবহার করলে ওয়াটারপ্রুফ কভার ব্যবহার করুন।
রাতে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ বা ইনানি সৈকতের দিকে ভ্রমণ না করাই ভালো। নিরাপত্তা এবং বিশ্রামের জন্য হোটেলে থাকুন।
সেন্ট মার্টিন বা ইনানি ভ্রমণের সময় স্থানীয় গাইড নিলে জায়গাগুলো সহজে ঘুরে দেখতে পারবেন।
৭. পর্যটন মৌসুমে অগ্রিম বুকিং করুন:
ভ্রমণের সময় আগে থেকেই হোটেল বুকিং নিশ্চিত করুন।
শীতকাল বা ছুটির মৌসুমে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনে অনেক ভিড় থাকে। অগ্রিম বাস, হোটেল বা জাহাজের টিকিট বুকিং দিন।
বাংলাদেশের সমুদ্রসৈকত তার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং সাশ্রয়ী ভ্রমণের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। কক্সবাজারের দীর্ঘ সৈকত, সেন্ট মার্টিনের শান্ত জল, ইনানি সৈকতের শান্ত পরিবেশ বা পতেঙ্গার দৃশ্যমান নৌকাগুলি - এখানে সবাই কিছু না কিছু খুঁজে পাবে। আপনার পরবর্তী ভ্রমণ পরিকল্পনা করুন এবং বাংলাদেশের সৈকতে একটি দুর্দান্ত অবকাশ উপভোগ করুন।
আপনার ভ্রমণ নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হোক
প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url